ওয়ালিমা কী?
বিয়ের পর ছেলের পক্ষে আত্বীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাংখী ও গরীব মিসকীনদের তৌফিক অনুযায়ী আপ্যায়ন করাকে ইসলামী পরিভাষায় ওয়ালিমা বলে। আমাদের সমাজে বা বাংলা ভাষায় যাকে বৌভাত বলে। বিয়ের পরদিন বা সুবিধামত সময়ে ওয়ালিমা করা যেতে পারে। তবে তিন দিনের মধ্যে হওয়া উত্তম।
ওয়ালিমার ব্যপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ কি ছিল?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে ওয়ালিমা করতে বলেছেন।
আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবদুর রহমান ইবনু আওফ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর গায়ে হলদে চিহ্ন দেখতে পেয়ে বললেন, কি ব্যাপার? তিনি বললেন, খেজুর বিচির পরিমাণ সোনার মোহরের বিনিময়ে আমি এক মহিলাকে বিয়ে করেছি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “আল্লাহ্ তোমাকে বরকত দান করুন। ওয়ালিমা কর, একটি বকরী দ্বারা হলেও।” (বুখারী: ১০৯৪)
অতএব আমরা বুঝতে পারলাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদেরকে বিয়ের পর ওয়ালিমা করতে উৎসাহিত করছেন।
বাসর রাতের পরদিন ওয়ালিমা করা সুন্নাতঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জয়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর সাথে বাসর রাত অতিবাহিত করার পর ওয়ালিমা করেছিলেন। (বুখারী:৫১৭০)
তবে তিন দিন পর্যন্তও বিলম্বিত করা যায়। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাফিয়া (রাঃ) কে বিবাহের পর তিন দিন পর্যন্ত ওয়ালিমা খাইয়ে ছিলেন। (মুসনাদে আবু ইয়ালা:৩৮৩৪)
ওয়ালিমা করতে হবে সামর্থ্য অনুযায়ীঃ
ওয়ালিমায় প্রচুর খরচ করতে হবে এবং খুব সুস্বাদু এবং দামী খাবার পরিবেশন করতেই হবে এরূপ জরুরী নয়। বরং যে বিয়েতে কম খরচ হয় সেই বিয়েকে বরকতময় বলা হয়েছে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “নিশ্চয়ই সে বিয়ে বেশি বরকতময়, যে বিয়েতে খরচ কম হয়।” (মুসনাদে আহমাদ)
কিন্তু আমাদের বর্তমান সমাজে এই সুন্নাত ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা করে বিয়েতে খরচ করা হয়। অতিরিক্ত জাঁকজমক এবং অপচয় করা হয় যা সুন্নাত বিরোধী।
তবে সামর্থ্য থাকলে কেউ ওয়ালিমায় অনেক খরচ করতেও পারে।
যেমন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জয়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) এর সাথে বিয়ের ওয়ালিমায় অনেক বেশি রুটি গোস্ত দ্বারা তৃপ্তি সহকারে সাহাবাদেরকে খাওয়াইয়েছিলেন।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, রাসুলুলাহ (সাঃ) যখন জয়নব বিনতে জাহাশ (রাঃ) কে বিয়ে করলেন, তখন ওয়ালিমা করালেন এবং মানুষকে রুটি গোস্ত দ্বারা তৃপ্তি সহকারে খাওয়ালেন।” (বুখারীঃ ৪৭৯৪)
কিন্তু এসব বিয়েতে না ছিল কোন অপব্যয় বা অপচয়।
আবার, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খুব সাধারণ খাবার দিয়েও ওয়ালিমা করেছিলেন। যেমন তিনি যখন সাফিয়া (রাঃ) কে বিয়ে করেন তখন ওয়ালিমা করেছিলেন খুব সাধারণ খাবার দিয়ে।
হজরত আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) বলেন, খায়বার থেকে ফিরে আসার সময় রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) খায়বার এবং মদীনার মধ্যস্থলে তিন দিন অবস্থান করলেন এবং ছাফিয়া (রাঃ) কে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ওয়ালিমার ব্যবস্থা করলেন আর আমি মুসলিমদের তাঁর ওয়ালিমার জন্য দাওয়াত করলাম। এই ওয়ালিমায় রুটি গোশত কিছুই ছিলনা। এই ওয়ালীমার জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম চামড়ার দস্তরখান বিছানোর আদেশ করলেন। অতঃপর এই দস্তরখানের উপর খেজুর, পনির ও ঘি ঢেলে দেওয়া হল। (বুখারীঃ৫৩৮৭, মিশকাতঃ ৩২১৪)
বিয়ে সংক্রান্ত আরো কিছু জরুরী বিষয়ঃ
এছাড়া বিয়ে সংক্রান্ত আরো অনেক সুন্নাত আছে। যেমন বিয়ে হতে হবে অনাড়ম্বর ও সাদাসিধে। অপব্যয়, অপচয় ও বিজাতীয় সংস্কৃতিমুক্ত হওয়া, যৌতুকের শর্ত না থাকা এবং সামর্থ্যের অধিক দেনমোহর ধার্য না করা বা শর্ত না দেওয়া। (আবু দাউদঃ ২১০৬)
কনে পক্ষে থেকে অলংকারের শর্ত করা নিষেধ আর ছেলের পক্ষ থেকে যৌতুক চাওয়া হারাম। (আহসানুল ফাতওয়া, খন্ড-৫, পৃষ্ঠা-১৭)
ওয়ালিমা এর দাওয়াতে উপস্থিত হওয়া উচিৎ কিনা?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই প্রসঙ্গে বলেন, “তোমাদেরকে যদি দাওয়াত করা হয় তাতে আসবে”- (তিরমিজিঃ১০৯৮)
অর্থাৎ ওয়ালিমার দাওয়াত পেলে উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব।
তবে বর্তমান জামানায় যেভাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে সুন্নাত বিরোধী কাজ করা হয় তাতে আপত্তি আসছে এসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার ব্যাপারে।
ইবনে উছাইমান (রঃ) বলেন, আলেমগন বলেন, বিয়ের প্রথম দাওয়াত কবুল করা ওয়াজিব। অর্থাৎ প্রথম ওয়ালিমায়।
যদি নিমন্ত্রনকারী কিম্বা তাঁর প্রতিনিধি কিম্বা কার্ড প্রদান করে নির্দিস্ট কোন ব্যক্তিকে দাওয়াত প্রদান করা হয়। তবে শর্ত হচ্ছে- এ অনুষ্ঠানে যেন শরিয়াত গর্হিত কোন কিছু না থাকে। আর যদি এ অনুষ্ঠানে শরিয়াত গর্হিত কোন কিছু থাকে তাহলে এর হুকুম ব্যাখ্যা সাপেক্ষঃ যদি ব্যক্তি উপস্থিত হয়ে এই গর্হিত কাজে নিষেধ করা সম্ভবপর হয় তাহলে এ ব্যক্তির জন্য উপস্থিত হওয়া ওয়াজিব। আর যদি উপস্থিত হয়ে এ কাজে বাধা প্রদান সম্ভব না হয় তাহলে তাঁর জন্য এখানে উপস্থিত হওয়া নাজায়েজ। (islamicqa.info )
বিনা দাওয়াতে ওয়ালীমা খেতে আসা যাবে কী?
বিনা দাওয়াতে ওয়ালিমা এর খানা খাওয়া যাবেনা। আবূ মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ শুআয়ব নামে এক ব্যক্তি তার গোশত ওয়ালা গোলামকে গিয়ে বলল, পাঁচ জনের জন্য যথেষ্ট হয় সে পরিমাণ খাবার তৈরী কর।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন (দাওয়াতে যাওয়ার জন্য) উঠলেন তখন এক ব্যক্তি যে দাওয়াত করার সময় তাদের সঙ্গে ছিল না, তাদের পিছনে পিছনে চলল।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তার দরজায় এসে পৌঁছেলেন, তখন বাড়ীওয়ালাকে বললেন, একজন লোক আমাদের অনুসরণ করেছে, যে দাওয়াতের সময় আমাদের সঙ্গে ছিলনা। এখন যদি অনুমতি দাও তবে সে প্রবেশ করতে পারে। আবূ শুআয়ব বললেন, আমি তাকে অনুমতি দিলাম, সে প্রবেশ করুক।
( তিরমিজিঃ ১০৯৯, আল মাদানী প্রকাশনী)
ওয়ালিমা কার পক্ষ থেকে হবে?
ওয়ালিমা হবে ছেলের পক্ষ থেকে। আর কনের পক্ষ থেকে যে ওয়ালিমা এর আয়োজন করা হয় তা শরিয়াত সম্মত নয়। বিয়েতে মেয়ের পক্ষ থেকে কোনরূপ খরচ করার কথা নয়।
তবে যেটা মেয়ের পক্ষ থেকে করে থাকেন তা সৌজন্যমুলক আপ্যায়ন মাত্র।
শর্ত দিয়ে, বর যাত্রীর সংখ্যা বাড়িয়ে কনে পক্ষের উপর যে খরচের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় যা সম্পূর্ণ কুপ্রথা ও অবশ্যই বর্জনীয়।
ওয়ালিমাতে উপহার বা হাদিয়া প্রদানঃ
উপহার বা হাদিয়া দেওয়া বা নেওয়া উভয়ই সুন্নাত। কোন প্রকার শর্ত ছাড়া, স্বার্থ বিবেচনা না করে কার প্রতি অনুরাগী হয়ে যে দান বা উপঢৌকন প্রদান করা হয় তাকেই উপহার বা হাদিয়া বলে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাদিয়া প্রদান করতে উৎসাহিত করেছেন।
“তোমরা হাদিয়া দাও, তোমাদের মধ্যে প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হবে।”- তিরমিজি।
হাদিয়া বা উপহার দেওয়ার জন্য বিশেষ কোন অনুষ্ঠান জরুরী নয়। যেকোন সময়, যে কাউকে হাদিয়া দেওয়া যেতে পারে।
আবার হাদিয়া কোন ঋণ বা পাওনা নয়। অর্থাৎ হাদিয়া সাধ্য না হলেও কস্ট করে দিতেই হবে বা হাদিয়া না থাকলে বা না দিলে অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবেনা আসলে ব্যপারটা এরূপ নয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, উত্তম বাক্য ও ক্ষমা প্রার্থনা ঐ দান অপেক্ষা শ্রেয়তর, যে দানের পর কষ্ট অনুগামী হয়। (সুরা বাকারাঃ ২৬৩)
যিনি দাওয়াত প্রদান করেছেন তিনি যেন মনে না করেন যে মেহমানকে যেহেতু দাওয়াত দিয়েছি তাই তাঁর সাধ্য থাক আর না থাক হাদিয়া দিতেই হবে। কেউ যদি হাদিয়া ছাড়া অনুষ্ঠানে বা কারো কাছে যায় তাহলেও ঐ মেহমানকেও সম্মান করতে হবে,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “যে আল্লাহ এবং আখিরাতের উপর ঈমান রাখে সে যেন তাঁর মেহমানকে সম্মান করে।”- তিরমিজি।
অতএব আমরা এই আলোচনা থেকে জানতে পারলাম বিয়েতে ওয়ালিমা করতে হবে সাদাসিধাভাবে, তবে সাধ্য থাকলে ভাল খাবার এর আয়োজন করলে তাতে দোষের কিছু নেই, তবে অপব্যয়, অপচয় করা যাবেনা। বিজাতীয়, অপসংস্কৃতি, শরিয়াত বিরোধী কোন কিছু করা যাবেনা। ওয়ালিমা হবে ছেলের পক্ষ থেকে।
ওয়ালিমা বিয়ের একটি জরুরী অংশ। আমাদেরকে বিয়েতে ওয়ালিমা করতে হবে। ওয়ালিমা এর ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো মেনে চলার চেষ্টা করতে হবে।