বিয়ে প্রতিটি নারী এবং পুরুষের জীবনেই গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বিয়ে একটি সামাজিক স্বীকৃতি যার মাধ্যমে একজন নারী ও একজন পুরুষ একসাথে জীবনের নতুন এক অধ্যায় শুরু করেন। বিয়ের আগের জীবন ও পরের দৈনন্দিন জীবনে অনেক পরিবর্তন আসে।
প্রশ্ন হলো এই পরিবর্তন গুলোর সাথে তাল মিলিয়ে কিভাবে সফল দম্পতি হওয়া যায়?
একজন পুরুষের অভ্যাস, রুচিবোধ ইত্যাদির সাথে নারীর রুচিবোধ ও অভ্যাসে সাধারণত বেশ কিছু অমিল থাকে। নারীরা বিয়ের আগে বাবা, বড় ভাই, মামা, চাচা বা অন্য কোন পুরুষের অধীনে থাকলেও তারা তাকে পুরাপুরি নিয়ন্ত্রণ করে না যেভাবে একজন স্বামী তার স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রন করতে চায়।
যেমন, বাবার অধীনে একজন মেয়ে জীবনের অনেক বড় একটি সময় কাটায়। এই সময়ে সে তেমন কোন সমস্যার সন্মুখীন হয়না। অধিকাংশ বাবা সহজেই তার মেয়ের সকল আবদার, দাবীকে মেনে নেয়। কিছুটা শাসন করলেও বাবার প্রতি মেয়েরা সাধারণত তেমন অভিযোগ, রাগ বা জিদ করেনা।
বাবা তার সন্তান তথা মেয়েকে লালন পালনের ক্ষেত্রে নিজ স্ত্রীর সহযোগিতা পায় অর্থাৎ বাবার সকল চাহিদা কিন্তু মা মিটিয়ে থাকে। ফলে বাবার সাথে সন্তানের মানে মেয়ের ব্যপারটি হল বাবা তার মেয়ের কাছে থেকে কোন কিছু আশা করেনা শুধু দিতে চায়। ফলে বাবা হয়ে উঠে মেয়ের কাছে একজন আদর্শ পুরুষ। আর তখন থেকেই একজন মেয়ে আশা করতে থাকে বা স্বপ্ন দেখতে থাকে যে তার স্বামীও হবে তার বাবার মত এরকম একজন পুরুষ।
কিন্তু যখন তার বিয়ে হয়ে যায় তখন সে স্বামীর দায়িত্বে চলে আসে। এই সময় তার রুচি, অভ্যাস ও জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আনতে হয়। নতুন জীবনে যে যত দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে তার বিবাহিত জীবন তত দ্রুত সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে।
বাবা যেভাবে আদর করে সমস্যা সমাধান করে দিত; আপনার জীবনসঙ্গী আপনার সমস্যাকে বা আপনার পছন্দ-অপছন্দ বা মতামতকে সেভাবে প্রাধান্য নাও দিতে পারে। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপনাকে মানিয়ে নিতে হবে অথবা তাকে ধৈর্য্য সহকারে বুঝিয়ে দিতে হবে আপনি তার কাছে কি প্রত্যাশা করেন।
বাবা আপনার কাছে কিছু আশা করতেন না শুধু দিয়ে যেতেন। আর আপনাকে শিক্ষা দিতে চাইতেন কিন্তু আপনার স্বামী আপনার কাছে অনেক কিছু আশা করবে যা আপনাকে পূরণ করতে হবে।নিজের বাড়ি ছিল আপনার জন্য পাঠশালার মত আর স্বামীর ঘর কর্মস্থলের মত। স্বামীর বাড়িতে পারফর্মেন্স দেখাতে হবে বিশেষভাবে স্বামীর যত্ন নেওয়ার ব্যপারে। আর একজন ছেলে যে তার মাকে দেখেছে ছোট বেলা থেকে যে মা তার কত যত্ন নেয়।
আর সে যখন বিয়ে করে সে তার স্ত্রীর কাছেও মায়ের মত যত্ন, আদর আর ভালবাসা আশা করে। কিন্তু মায়ের বিচক্ষণতা কখনও একজন স্ত্রী পেতে পারেনা। কারন মা তার ছেলের অভ্যাস, রুচিবোধ সম্পর্কে জানে যা একজন স্ত্রীর জানতে বা বুঝতে অনেক সময় লাগে।
অপরদিকে মা তার প্রয়োজনীয় প্রায় সব কিছু সাধারণত পেয়ে থাকে বাবার কাছে থেকে। এজন্য মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্কে শুধু থাকে দেওয়া কোন কিছু পাওয়ার নয়। এজন্য মা খুব প্রিয় এক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠে প্রত্যেক সন্তানের কাছে।
কিন্তু স্ত্রী যেহেতু সব কিছুই তার স্বামীর কাছে আশা করে তাই স্বামীও তার স্ত্রী এর কাছে পুরাপুরি আশা করে।
যাই হোক স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে ছাড় দেওয়ার মনমানসিকতা থাকতে হবে। তাহলে পরস্পরের মধ্যে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠবে।
দুটি মানুষের মানসিকতা বা চিন্তাধারা কখনোই এক হবে না। সুতরাং একসাথে থাকতে গেলে দুজনকেই কিছু ব্যাপারে সমঝোতা করে একে অপরের সহযোগীতা নিয়ে চলতে হবে। আসুন জেনে নিই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা টিপস যা আপনাদেরকে দাম্পত্য জীবনে সফল হতে সাহায্য করবে।
তার মতামতকে প্রাধান্য দিনঃ
বিবাহিত জীবনে প্রথম সমস্যাই হয় এই মতামতকে নিয়ে। আপনার মতামতের পাশাপাশি আপনার জীবনসংগীর মতামতকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। যে কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে দুজনে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধানে আসতে হবে। নিজের মতামত অযৌক্তিকভাবে চাপিয়ে দেয়া যাবে না। তবে অবশ্যই একজন প্রধান সিদ্ধান্ত দাতা বা নেতৃত্বে থাকতে হবে। আর এক্ষেত্রে, স্বামীই এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। তবে স্বামী অবশ্যই তার স্ত্রী এর মতামত নিবেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটা তিনিই নিবেন। হ্যাঁ কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রীই নেতৃত্ব দিবেন যেমন রান্না-বান্না, ঘর গুছানো, সন্তান লালন-পালন এর মত পারিবারিক কাজ গুলি। তবে অবশ্যই স্বামীর মন বুঝে সে অনুযায়ী সবকিছু করবেন।
নিজেকে সুন্দর পোশাকে উপস্থাপন করুনঃ
আমরা অনেক সময় ঘরের বাইরে বের হলে সুন্দর ভাবে পরিপাটি হয়ে বের হই; অথচ নিজের স্ত্রী বা স্বামীর জন্য তেমন সাজগোজ করিনা। আপনার ভালবাসার মানুষটির সামনেও আপনার সুন্দরভাবে উপস্থিত হওয়া উচিৎ। এতে একে অপরের প্রতি ভালবাসা বাড়বে।
আপনার ভালবাসার মানুষটির প্রতি অবহেলা নয়, যত্নবান হোনঃ
অবহেলা যে কোন সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার একটি অন্যতম কারণ। সুতরাং আপনার একান্ত আপন মানুষটির প্রতি যত্নবান হোন। আপনার কাজকর্মের মাধ্যমে তার প্রতি আপনার ভালবাসা প্রকাশ করুন। প্রতিদিন ভালবাসতে শিখুন। আপনার ঘরের ভিতরে থাকা ফুল গাছের টবে যেমন প্রতিদিন পানি দিতে হয়ে নইলে একদিন গাছটি মারা যাবে ঠিক তেমনি আপনার লাইফ পার্টনারকে প্রতিদিন ভালবাসুন। তাহলে ভালবাসার গাছটি দিনে দিনে বড় হয়ে উঠবে।
স্পষ্টভাষী হোনঃ
সন্দেহ হয় বা বুঝতে সমস্যা হয় এরকম কোন কথা বলা থেকে বিরত হতে হবে। স্বামী স্ত্রীর মাঝে কোন গোপনীয়তা থাকা উচিত নয়। কথা বলার সময় নিজ জীবনসঙ্গীকে যে আপনি ভালবাসেন বা তাকে সন্মান করছেন তা বুঝাতে হবে। সত্য কথা বলুন আর মিথ্যা একেবারেই বলবেন না।
বিশ্বস্ত থাকুনঃ
বিশ্বস্ততার কোন বিকল্প নেই। আপনার কাছে বিশ্বস্ততার আশ্বাস পেলে সেও আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। আমরা কেউই প্রিয়জনের কাছে প্রতারিত হতে চাই না। তাই নিজ স্বার্থেই তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন।
সন্দেহ খুব ক্ষতিকর জিনিস। সন্দেহ সম্পর্কের ক্ষতি করে। তাই যেকোন বিষয়ে সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিতে হবে। তবে অবশ্যই বিনয়ের সাথে বলতে হবে। আর বেশি সন্দেহ করাও ঠিক নয়। আর সকল বিষয় খোলামেলা আলোচনা করতে হবে, একে অপরের কাছে কোন কিছু লুকানো যাবে না।
মনোমালিন্যঃ
বিবাহিত জীবনে সব সময় যে আপনার সাথে মধুর ব্যবহার হবে, কখন তর্ক বা ঝগড়া লাগবেনা তা কিন্তু ঠিক নয়। বরং তর্ক বা ঝগড়া লাগবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই সব বিষয়কে দীর্ঘায়িত হতে দেওয়া যাবেনা। স্বামী বা স্ত্রীর বিবাহিত জীবনের আগে ঘটে যাওয়া কোন কথা বলে কস্ট দেওয়া যাবে না। ঝগড়ার সময় পুরনো কথা বলবেন না।
আমরা অন্যের কথাকে খুব মনযোগের সাথে শুনি কিন্তু নিজ জীবনসঙ্গীর কথাকে গুরুত্ব দেই না। আর যখন আপনার লাইফ পার্টনার বুঝবে যে আপনি তাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না ঠিক তখন থেকেই পরস্পর সন্দেহ বেড়ে যাবে। তাই আপনার লাইফ পার্টনার যখন কোন কথা বলে তা মনযোগ সহকারে শুনুন তাতে মনমালিন্য কমে যাবে।
এক সাথে সময় কাটানঃ
স্বামী স্ত্রীর সাথে সু-সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য এক সাথে সময় কাটানোর কোন বিকল্প নেই। স্বামী-স্ত্রী যত বেশি সময় এক সাথে কাটাবে ততই তাদের মধ্যে সু-সম্পর্ক বাড়তে থাকবে। অপর দিকে যদি বিপরীত হয় তাহলে সন্দেহ বাড়বে; তাই পরিবার পরিজনকে সময় দিতে হবে। স্বামী স্ত্রীর একান্তে সময় কাটানো, মনের সব কথা খুলে বলার জন্য অবশ্যই নিজেদের শয়ন কক্ষ থাকতে হবে। আর প্রত্যেক স্ত্রী তার স্বামীর সাথে একান্তে সময় কাটাতে চায়। তাই কষ্ট হলেও অন্তত ছোট করে বিয়ের আগেই একটি কক্ষ বানাতে হবে নিজেদের জন্য। তবে আলাদা বিছানা করে থাকা যাবেনা। এতে দুরুত্ব বাড়বে।
কারণ শারীরিক দুরুত্ব বাড়লে মানসিক দুরুত্বও বেড়ে যেতে পারে।
কিছু সমস্যা সব সময় থাকবেই সেগুলোকে মেনে নিতে হবেঃ
বিপদ আপদ, দুঃখ কস্ট সহ কিছু অপছন্দণীয় বিষয় আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব অপছন্দনীয় বিষয় থাকবেই। এগুলো একেবারে শেষ হয়ে যাবে না; কখন বাড়বে বা কখন কমবে। তাই এসব বিষয়কে স্বাভাবিকভাবে নিতে হবে এবং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।
একে অপরের কিছু ভাল দিক খুঁজে বের করাঃ
আপনার জীবন সঙ্গীর অনেক বিষয়ই হয়তো আপনার কাছে ভাল লাগে না। তারপরও তার কিছু ভাল গুন রয়েছে সেগুলোকে খুঁজে বের করুন এবং তা প্রকাশ করে দিন অর্থাৎ কিছু সুনাম সামনসামনি করুন দেখবেন কি এক আনন্দের পরিবেশ হয়ে যাবে।
ক্ষমা করার অভ্যাস করতে হবেঃ
আমরা কেউ ভুলের বাইরে নই। ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আর ভুলকে মাথার মধ্যে না রেখে অন্তর থেকে ক্ষমা করে দিন। এতে পরস্পরের প্রতি সন্মানবোধ, ভালবাসা বাড়বে।
একে অপরকে সালাম দেওয়া, ধন্যবাদ দেওয়া, আল্লাহ হাফেজ, ফি আমানিল্লাহ বলা ইত্যাদি অভ্যাস গড়ে তুলতে হবেঃ
আমরা ভিন্ন পুরুষ বা নারীকে সন্মান করি বা সালাম দেই অথচ নিজ জীবন সঙ্গীকে সালাম দেই না, ধন্যবাদ দেই না। অথচ সালাম পাওয়ার বেশি হকদার হল নিজের জীবন সঙ্গী।
নিজেদের সমস্যা নিজেরা মিটিয়ে ফেলাঃ
সমস্যা জীবনে আসতেই পারে এটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয়। তবে এই সমস্যা নিজেরা সমাধান করার চেষ্টা করতে হবে। নিজের বন্ধু, ভাই বোন বা অল্প বয়স্ক কার কাছে সমস্যার কথা বা ঝগড়ার কথা বলা যাবেনা। এতে সমস্যা সমাধান না হয়ে বাড়তে থাকবে। অবশ্য সমস্যা গোপন করলে যদি তা আরো বড় হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাহলে নিজের সবচাইতে আপনজনকে জানাতে হবে। যেমন নিজ মা, বাবা বা কোন আপনজন যে ধীরস্থির ভাবে সমস্যাটি সমাধানে সাহায্য করতে পারে। তবে গোপন করা বা নিজে সমাধানের চেষ্টা করাই উত্তম।
আপনার জীবনসঙ্গীকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিনঃ
কখনই নিজ স্ত্রী/স্বামীর চেয়ে আপন বা বিশ্বস্ত কেউ থাকা যাবেনা। আর আপনার স্বামী/স্ত্রী যদি কোন ভাবে বুঝতে পারে যে তার চেয়ে প্রিয় বা বিশ্বস্ত কেউ আপনার জীবনে আছে তাহলে আপনি কখন বিবাহিত জীবনে সুখী হতে পারবেন না। বিয়ের আগে যদি কেউ তেমন থেকেও থাকে বিয়ের পর কোনভাবেই তার সাথে সম্পর্ক রাখা যাবে না।
আসুন আমরা আমাদের বিবাহিত জীবনে এসব অভ্যাস গড়ে তোলার চেস্টা করি।সবাই ভাল থাকবেন এই শুভ কামনা রইল- আল্লাহ হাফেজ।
আলহামদুলিল্লাহ! খুব সুন্দর!