তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত পালন

ইসলাম নারীদের সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছে এবং তাদের অধিকার সঠিক ভাবে বন্টন করতে বলেছে। ইদ্দত শুধুমাত্র স্বামী মারা গেলে বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে প্রযোজ্য। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী নিয়ম অনুযায়ী সব দিক নির্দেশনার প্রতি লক্ষ্য রেখে ইদ্দত পালন করেই বিয়ে করতে পারবেন। ইদ্দত পালন করার পর বিয়ে তার জন্য সম্পূর্ণ বৈধ। কিছু নিয়ম-কানুন আছে যেটা মেনে চললে খুব সহজেই জীবনটাকে সুন্দর করে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

ইদ্দত একটি আরবি শব্দ যার অর্থ হল গণনা! স্ত্রী তালাকপ্রাপ্তা হলে বা তার স্বামীর মৃত্যু হলে যে সময়ের জন্য উক্ত স্ত্রীকে এক বাড়ীতে থাকতে হয়, অন্যত্র যেতে পারে না বা অন্য কোথাও বিবাহ বসতে পারে না তাকে “ইদ্দত” বলে।

কোন নারীর স্বামী যদি তাকে তালাক দেয়, তাহলে তিনি এর পর পরই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেন না। এই সময়ের মধ্যে যদি নারীর গর্ভধারণের লক্ষণ প্রকাশ না পায় তাহলে তিনি ইদ্দত শেষ হয়ে গেলেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবেন। আর যদি গর্ভ প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে তার ইদ্দত এর সময়কাল হবে সন্তান জন্ম দেওয়া পর্যন্ত। এরপর সন্তান জন্ম নিলেই তার ইদ্দতের সময়সীমা শেষ এবং তিনি পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন।

তালাকপ্রাপ্তা নারীর ক্ষেত্রে:

কোনো স্বামী যদি তার স্ত্রীকে তালাক প্রদান করে থাকে তাহলে তার ইদ্দত হলো তিন মাসিক পর্যন্ত।

আল্লাহ তা’আলা বলেন- ‘‘আর তালাকপ্রাপ্ত নারী নিজেকে অপেক্ষায় রাখবে তিন মাসিক পর্যন্ত।’’ (সূরা বাকারা,আয়াতঃ ২২৮)

বলা যেতে পারে তালাকপ্রাপ্ত স্বামী-স্ত্রীর জন্য ইদ্দত নির্ধারণের মূল লক্ষ্য হলো তাদেরকে পুনরায় সুযোগ করে দেয়া। তালাক প্রদানকারী যদি কখনো তার ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে শুধরে নিতে চায় সেটারই একটা সুযোগ করে দেয়া।ইদ্দতপালনকালে স্ত্রীকে স্বামীর ঘরেই অবস্থান করতে হয়। ইদ্দত যদি তালাকের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে স্বামীই তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে।

আল্লাহ পাক বলেন,

“তোমরা তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী যেরূপ গৃহে বাস কর, তাদেরকেও সেরূপ গৃহে বাস করতে দিবে; সংকটে ফেলার জন্যে তাদেরকে উত্যক্ত করবে না। (তালাক : ৬৫: ৬)”

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে সূরা তালাকে এরশাদ করেন,

‘‘হে নবী! (উম্মতকে বলুন) তোমরা যখন স্ত্রীদেরকে তালাক দিতে চাও, তখন তাদেরকে তালাক দিয়ো ইদ্দতের প্রতি লক্ষ্য রেখে এবং ইদ্দত গণনা করো। তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাাহকে ভয় করো। তাদেরকে তাদের গৃহ থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও যেন বের না হয় যদি না তারা কোন সুস্পষ্ট নির্লজ্জ কাজে লিপ্ত হয়। এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। যে ব্যক্তি আল্লাহর সীমা লংঘন করে, সে নিজেরই অনিষ্ট করে। তুমি জান না, হয়তো আল্লাহ এরপর কোন নতুন উপায় করে দেবেন।” (সূরা তালাক- ৬৫:১)

শোক পালনের সময়কাল:

তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে ইদ্দত পালনের সম্পূর্ণ সময়কাল অবশ্যই শোক পালন করতে হবে। শোক পালন বলতে তার জাঁকজমক- চাকচিক্য জামাকাপড়, অলংকার, সাজগোজ, মেহেদী, সুরমা, সুগন্ধি ইত্যাদি যা নারীর প্রতি আকষর্ণ বাড়াতে পারে সে সমস্ত জিনিস ব্যবহার করা যাবে না। কোন স্ত্রী যদি এইভাবে শোক পালন না করে, তাহলে সে গুনাহগার হবে। সব নিয়ম-কানুন মেনে পর্দা করে মার্জিত ভাবে ইদ্দত পালন করতে হবে। তবে তালাক যদি রজয়ী  হয়, তাহলে ইদ্দতের সময় স্ত্রীকে স্বামীর সামনে পর্দা করতে হবে না। বরং সে সেজেগুজে পরিপাটি হয়ে থাকবে। এতে করে স্বামীর অন্তরে তাকে আবারও স্ত্রী হিসেবে ফিরিয়ে নেয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু তালাক যদি বায়েন কিংবা মুগাল্লাজা হয় তাহলে স্বামীর সঙ্গেও পর্দা রক্ষা করেই থাকতে হবে।

(রজয়ী একটা আরবী শব্দ, যার শাব্দিক অর্থ হলো; ফিরিয়ে নেওয়া, প্রত্যাবর্তন করা, কিছু কিছু সময় তালাকের শব্দ বলার পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যায় আর যে তালাকের পরও স্ত্রীকে ফিরিয়ে নেওয়া যায়, তাকে তালাকে রজয়ী বলে।)

 

 

ইদ্দত পালনকারী নারীকে বিয়ে করা হারাম:
ইদ্দত পালনরত কোনো নারীকে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেওয়াও বৈধ না। তালাক প্রদানকারী স্বামীর বিষয়টি অবশ্য ভিন্ন। তালাক যদি রজঈ হয়, তাহলে স্বামী চাইলে ইদ্দতের মধ্যে স্ত্রীকে রজাআত করে নিতে পারে। আর যদি এক বা দুই বায়েন তালাক হয়, তাহলে ইদ্দতের মধ্যেই স্বামী তাকে নতুন করে বিয়ে করতে পারবে।

“নারীদের নিকট তোমরা ইঙ্গিতে বিয়ের প্রস্তাব করলে অথবা তোমাদের অন্তরে গোপন রাখলে তোমাদের কোনো পাপ হবে না। আল্লাহ জানেন, তোমরা তাদের সম্বন্ধে অবশ্যই আলোচনা করবে, কিন্তু বিধিমতো কথাবার্তা ব্যতীত গোপনে তাদের নিকট কোনো অঙ্গীকার করো না, এবং নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে সম্পন্ন করার সংকল্প করো না।” (বাকারা : ২ : ২৩৫)

ইদ্দতকাল সম্পূর্ণ ভাবে পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত কোনভাবে সেই স্ত্রীর সাথে গোপনীয় কোনো অঙ্গীকার বদ্ধ হতে পারবে না। সব নিয়ম মেনে নিয়ে কথা বলা যাবে কিন্তু বিয়ে সম্পর্কিত কোনো ধরণের আলাপ করা যাবে না ইদ্দত এর সময় সীমা শেষ না হওয়া পর্যন্ত। স্ত্রী কে যতটা সম্ভব শালীনতা বজায় রেখে পর্দা করে মার্জিত ভাবে চলতে হবে।

দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখতে হবেঃ 

এক. যে নারীকে বিয়ের পর সহবাসের পূর্বে তালাক দেওয়া হয় তার ওপর কোনো ইদ্দত নেই।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“হে মুমিনগণ, যখন তোমরা মুমিন নারীদেরকে বিবাহ করবে অতঃপর তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে দেবে, তাহলে তোমাদের জন্য তাদের কোনো ইদ্দত নেই যা তোমরা গণনা করবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৪৯]

দুই. বিয়ের পর সহবাসের পূর্বে তালাকপ্রাপ্তা নারীর জন্য যদি মাহর নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তাকে অর্ধেক মাহর দিবে, আর যার মাহর নির্ধারণ করা হয় নি তাকে মুত‘আহ অর্থাৎ স্বামীর সাধ্য মোতাবেক পোশাক ইত্যাদি প্রদান করবে। তবে সহবাসের পর যাকে তালাক দেওয়া হয়, সে অবশ্যই মাহরের হকদার।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

“তোমাদের কোনো অপরাধ নেই যদি তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দাও এমন অবস্থায় যে, তোমরা তাদেরকে স্পর্শ কর নি কিংবা তাদের জন্য কোনো মাহর নির্ধারণ কর নি। আর উত্তমভাবে তাদেরকে ভোগ-উপকরণ দিয়ে দাও, ধনীর ওপর তার সাধ্যানুসারে এবং সংকটাপন্নের ওপর তার সাধ্যানুসারে। সু-কর্মশীলদের ওপর এটি আবশ্যক। আর যদি তোমরা তাদেরকে তালাক দাও, তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বে এবং তাদের জন্য কিছু মাহর নির্ধারণ করে থাক, তাহলে যা নির্ধারণ করেছে, তার অর্ধেক (দিয়ে দাও)”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৬-২৩৭]

দাম্পত্য জীবন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় ও বিশেষ একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রী সকলের কর্তব্য, এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং একে অপরের সকল অধিকার আদায় করা। স্ত্রীর জন্য উচিত নয়, কথায় কথায় স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও জায়েজ নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করা।

শেয়ার করুন

8 thoughts on “তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত পালন

  1. আসসালামু আলাইকুম। আমার এক বান্ধবী তালাক প্রাপ্ত হলে সে ইদ্দত পুরা না করেই অনত্র বিয়ে করে এবং সেখানে প্রেগনেন্ট হয়ে গেলে বাচ্চা নষ্ট করে ফেলে। যখন সে জানতে পারে তাদের বিয়ে বৈধ না। এখন আমার বান্ধবীর করনীয় কি জানালে উপকার হবে।

  2. আসসালামু আলাইকুম,,,,
    আমি একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী, কিন্তু আমি এই ইদ্দতকাল সম্পকে কিছুই জানতাম না, যার কারণে ইদ্দকাল সময়টা মেনে চলতে পারি নি,, আমার তালাকের আজ তিন বছর পর এইসব সম্পকে জানতে পারলাম, এখন কি আমার কিছু করণিয় আছে??

    1. আপনি কি আবার বিয়ে করেছেন? যদি করে না থাকেন তাহলে কোন সমস্যা নাই। আর যেহেতু আপনি বিষয়টি জানতেন না তাহলে কোন সমস্যা নাই।
      ধন্যবাদ।

  3. ইদ্দত কালীন স্ত্রী সাংসারিক কাজ কর্ম করতে পারবে? সন্তানদের মায়ায় থাকতে চাইলে তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী কিভাবে থাকবে??

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.