পারিবারিক জীবনযাপন শুরু হয়ে থাকে বিয়ের মাধ্যমে। এজন্য বিয়ের আগের ও পরের দৈনন্দিন জীবনে অনেক পরিবর্তন চলে আসে। বিয়ে হয়ে গেলেই যে সব দায়দায়িত্ব শেষ ব্যাপারটা কিন্তু তেমন নয় । দায়িত্বটা বরং বেড়েই যায়। শুধু আবেগ নয়, প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, দায়িত্ববোধ ও বিশ্বাস। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, উল্লেখযোগ্য হারে দিন দিন বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদের পরিমাণ। নানাবিধ কারণে হয়ে থাকে ব্যাপারটি।
বিয়ের আগের গোপনীয়তা
বিয়েটা যেভাবেই হোক, নিজের পছন্দ বা পারিবারিকভাবে, এমন কোন বিষয় গোপন করা উচিত না যেটা পরবর্তীতে জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। যদি কোনোকিছু গোপন করে থাকেন সে জানতে পারলে ভাববে আপনি তাকে ঠকিয়েছেন। এই সমস্যা থেকেই শুরু হয়ে গেল অবিশ্বাস কিংবা অশান্তির সূত্রপাত। বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এটা একটা বড় কারণ। বিশ্বাসই দাম্পত্য জীবনের মূল ‘চাবিকাঠি’৷
বয়সের সামঞ্জস্যতা
ছেলে বা মেয়ে যেই হোক না কেন বিয়ের জন্য কিন্তু উপযুক্ত একটা বয়সও বিশাল ব্যাপার। ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৭’ তে মেয়েদের বিয়ের বয়স ১৮ বছর, ছেলেদের ২১ বছর পাশ করা হয়েছে। বয়স কেন এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ? বয়সের ব্যাপারটা এজন্য এত গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিয়ে জন্য শারীরিক এবং মানসিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার মতো মানসিকতা থাকতে হবে।
একে অপরকে সম্মান করাঃ এটি এমন একটি সম্পর্ক যা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাকে কিভাবে সঠিকভাবে টিকিয়ে রাখা যায় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই পরষ্পরের প্রতি ভালবাসতে হবে এবং শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত।
ছুটির দিনে সঙ্গীকে সময় দেয়া
ইদানীং আমরা ক্যারিয়ার নিয়ে এতো বেশি ভেবে থাকি যে আমাদেরও একটা সংসার আছে সেটা ভুলে যাই। নিজের আপন মানুষগুলাকে সময় না দিয়ে অফিসের কাজ বা মিটিং করে থাকি। ছুটির দিনটাকে পরিবারের জন্য রেখে দিলে দেখবেন কত সুন্দর একটি সময় একসাথে কাটাতে পারছেন। শত ব্যাস্ততার মাঝেও কিছু সময় বের করুন আপনার পরিবারের জন্য। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শারীরিক সম্পর্ক। হাজার ব্যাস্ততার মাঝেও নিয়মিত শারীরিকভাবে নিজেদের সম্পর্ককে গড়ে তুলুন। সম্পর্ক হলো একটা গাছের মতো, যাকে প্রতিদিন পানি দিয়ে যত্ন করতে হয়।
ক্ষমা চাওয়ার মানসিকতা
ভুল কিন্তু সবারই হতে পারে। তাই স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনো ভুল বা অন্যায় করে থাকে, তাহলে সেটা একে-অপরকে জানিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিন৷ কেউ আগে ক্ষমা চাইলেই যে সে ছোট হয়ে যাবে ব্যাপারটি তেমন নয়। দু’জনই দু’জনের প্রতি বিশ্বাস রাখুন৷
সব কথা সবার সামনে না বলা
স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ ভুল করতেই পারে। ভুলটা যেই করুক না কেন ফ্যামিলি, বন্ধু-বান্ধব বা বাইরের যে কারো সামনে না বলাই ভাল কারণ পরবর্তীতে স্বামী- স্ত্রীর মধ্যে ৩য় পক্ষ ঢুকে পড়ে যেটা আপনাদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে থাকে।
সাপোর্ট দেয়া
যেকোনো ধরণের সমস্যা সম্মুখীন হলে একে অপরকে সাপোর্ট করুন। সেটা হতে পারে পারিবারিক, আর্থিক, মানসিক, অফিসিয়াল ইত্যাদি। কাজের চাপ, অতিরিক্ত সময় অফিসে থাকা নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ করবেন না। বরং দু’জনেই একে অপরের কাজের ক্ষেত্রটা এবং সমস্যা বোঝার চেষ্টা করুন।
তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া
একসাথে থাকলেই যে শুধু ভালোবাসতে হবে তেমন কিন্তু নয়। মাঝে মাঝে ঝগড়া করলে ভালোবাসাও বাড়ে। ঝগড়া হতেই পারে কিন্তু সেটা তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় কিছু করে ফেলা না। কিন্তু যখন ঝগড়াটা আর নিজেদের মধ্যে থাকে না তখন হয়ে যায় বিপত্তি। কখনোই নিজেদের বিষয়টি তৃতীয় পক্ষকে জানাবেন না এমনকি বাবার বাড়িতেও না।
নিজেদের মধ্যে যতই সমস্যা হোক না কেন বিছানা কখনো আলাদা করবেন না কারণ আস্তে আস্তে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যাবে। আরেকটা বিষয় হলো কখনো ঝগড়া হলে কেউ কাউকে বাসা থেকে বের হয়ে বলবেন না বা নিজেও যাবেন না।
আর্থিক অবস্থা
আর্থিকভাবে অবস্থা আছে কিনা বা কতটুকু সেটা কিন্তু বিয়ের আগেই দেখে নিচ্ছেন। বিয়ে হয়ে গেলে কেন এটা দিতে পারছে না ওটা পারছে না এভাবে বলে তাকে আর ছোট করবেন না। মানিয়ে চলার চেষ্টা করুন।
স্বাধীনতা
সবারই স্বাধীনভাবে চলার অধিকার আছে, কিন্তু সেটা করারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে । স্বামী-স্ত্রী দু’জনকেই দু’জনের সম্মতি নিয়ে কাজ করা উচিত। স্বাধীনতা মানেই কিন্তু অশ্লীলতা নয়। বিশ্বাস করে কেউ কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করে বরঞ্চ বুঝে কাজ করুন। আপনাকেও বুঝতে হবে আপনার সাথে অন্য একজনের জীবন জড়িয়ে আছে।
বাবা-মা এবং ছেলে-মেয়ে হিসেবে ভাবুন
মেয়েদের ক্ষেত্রে অনেকসময় দেখা যায় যে বিয়ের পরেও ভেবে থাকে তারা এখনও বাবার বাসায় আছে। কিন্তু তাদের যে নতুন একটা দায়িত্ব যোগ হয়েছে সেটা ভুলে গেলে হবে না। শশুর-শাশুড়ি কিন্তু আপনার বাবা-মায়ের মতো। আবার ছেলের বউ চলে এসেছে এখন সব দায়িত্ব বউ এর। এই চিন্তা করা ঠিক নয়, সময় দিন সবকিছুর জন্য। আবার দেখা যায়, মেয়ে জামাই যখন মেয়েকে কাজে সাহায্য করে খুব ভাল লাগে। বাহ আমার মেয়ের কপাল এত ভাল একটা জামাই পেয়েছে। এই কাজটা যখন আপনার ছেলে করে তখন আপনারাই বলে ওঠেন আমার ছেলে আর আগের মত নাই, বউয়ের গোলাম হয়ে গেছে।
স্ত্রী যখন চাকুরীজীবী
এখনকার অনেক মেয়েরাই চাকুরীজীবী। বিয়ের পর সংসার এবং অফিস দুইটাই সামলানো অনেক কঠিন। বাসায় ফিরে আবার রান্না এবং অন্যান্য কাজ থাকে। স্ত্রীকে সাহায্য করুন আপনার সাধ্যমত। কাজ ভাগাভাগি করে নিন৷ দেখবেন আপনাদের মধ্যকার সম্পর্কের কতটা পরিবর্তন হয়।
একে-অপরের প্রশংসা করুন
তোমাকে আজ সুন্দর লাগছে বা কাজটা অনেক ভাল করেছো- এই কথাগুলা বলার চেষ্টা করুন। সমালোচনা না করে মাঝে-মধ্যে একে-অপরের প্রশংসা করুন।
কখনো তুলনা না করা
আমার বন্ধুর বউ ওটা ভাল পারে তুমি কেন পারোনা? আমার কলিগ এর হাজব্যান্ড এত স্মার্ট আর ওর জন্য কি না করে! যখনই আপনাদের সম্পর্কের মধ্যে এমন করে অবহেলা বা তুলনা ব্যাপারটি চলে আসে তখনি বিপত্তি ঘটে। কি দরকার? ভালোইতো আছেন। তুলনা করে কেন নিজেদেরকে ছোট করতে হবে? অনেক সময় এটাও বিবাহ বিচ্ছেদের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়৷
প্রযুক্তিগত মিডিয়ার খারাপ দিক
সবকিছুরই ভালো-মন্দ দিক আছে। প্রযুক্তি আমাদেরকে যেমন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনি পিছনেও টানছে। যেমন মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা সারাবিশ্বের সব তথ্য জানতে পারি ঠিক তেমনি এর খারাপ দিক টাও আছে। ইদানিং দেখা যাচ্ছে পাশ্চাত্য দেশের সিরিয়ালের জন্য ব্যাপকভাবে সংসারে অশান্তি দেখা যায়। জীবনটা কিন্তু টিভি-সিরিয়াল না। বাস্তবতার সাথে সাজানো নাটকের কোনো মিল পাওয়া যাবে না। যখনই নিজের জীবনকে টিভি সিরিয়ালের মতো ভাবতে যাবেন, তখনি কিন্তু বিপত্তির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
পরকীয়ায় জড়ানো
ফেইসবুক, টুইটার, হোয়াটস্যাপ, ভাইভার, ইমো ইত্যাদি সোশ্যাল মিডিয়া বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য অনেকদিক থেকেই দায়ী। বাড়তি বিনোদনের জন্য অনেকেই নতুন বন্ধুর খোঁজে নিজের বিবাহিত জীবনটিকে দুর্বিষহ করে তুলছেন। অন্য পুরুষ বা মহিলার প্রতি বিয়ের পর আসক্তিকেই পরকীয়া বলা হয়ে থাকে। নানান ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হয়ে অনেকেই এই কাজটি করে থাকেন। কিন্তু সমস্যা যদি থাকে এর সমাধানও কিন্তু আছে। অনেকের পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারে। কিন্তু আপনার সমস্যাগুলা পার্টনারকে বুঝিয়ে বলে দেখুননা বাইরের প্রতি আসক্তি নাও হতে পারে। ভয়ংকর এই পরকীয়ার জন্য ঘটে বিবাহ বিচ্ছেদ।
আসলে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ খুঁজলে অনেক কিছুই পাওয়া যাবে। কিন্তু মাঝে মাঝে সংসারের জন্য হলেও ত্যাগ স্বীকার করুন। ডিভোর্স কথাটা খুব ছোট কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ না। এর সাথে শুধু দুইজন মানুষ না, দুইটা পরিবারের সবাই জড়িত। বিয়ের মাধ্যমে নতুন একটি সংসারের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সংসার ভাঙনের এই প্রবণতা দিন দিন কেবলই বাড়ছে। যখন পারস্পরিক ভালবাসা ও বিশ্বাস কমে যায়, তখন সেই সংসারের বন্ধন হালকা হয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে সংসার ভেঙ্গে যায়। সম্পর্কগুলোকে যত্ন নিন। দু’জন কিছুটা সচেতন ও আগ্রহী হলে বিবাহবিচ্ছেদ আটকানো যেতে পারে৷
আমি আপনার লেখাটা পরীক্ষার জন্য পরতে এবং নিজের জীবনে কাজে লাগাতে স্ক্রিন শট দিয়ে রেখেছি।