কালো মানেই কি অসুন্দর, কালো মানেই অবজ্ঞা? আর সেটা বেশি করে ঘটে নারীদের বেলাতেই। সৌন্দর্য বিচারের প্রকৃত মাপকাঠি কী? গায়ের রঙ কখনো একজন নারীর বিশেষত্ব হতে পারে না! আপনার পরিচয় আপনার ত্বকের রঙে নয়। ছোটবেলা থেকে এমন অনেকেই এই চিন্তাভাবনা নিয়ে বড় হচ্ছে যে, আসলে তার মধ্যেই কোন কমতি আছে। কিন্তু কেন?
ধারণাটি অনেক আগে দেখা যেত। এখনো দেখা যায় কিন্তু খুবই কম। কারণ এখন মেয়েরা তাদের নিজেদের যোগ্যতায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। কালো বা ফর্সা তাদের পিছনের দিকে টানতে পারেনি।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতি: আসলে আমাদের এই ধ্যান-ধারণা এসেছে কোথা থেকে? নানাভাবে সেটা পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতির সাথে জড়িত। আমরা একসময় শ্বেতাঙ্গ শাসিত হয়েছি। পরবর্তীতে দেখা গেছে সাদার আধিপত্য বেশি। আমাদের মাঝে এই কালো বর্ণের প্রতি নেতিবাচক ধারণা ব্যাপারটার সাথে এর সংযোগ থাকতে পারে।
মিডিয়া: এরপর আসা যাক মিডিয়া নিয়ে। আমরা সব সময় মিডিয়াকে খুব বেশি অনুসরণ করি। মিডিয়া আমাদের যেটা দেখাচ্ছে আমরা তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। যেমন রং ফর্সাকারী ক্রিম এর বিজ্ঞাপনে সবসময় দেখা যায় ৩-৭ দিনের মধ্যে ফর্সা হবার সম্ভাবনা। কালো বলে চাকরি বা বিয়ে হচ্ছে না এমন কিছু দৃশ্য প্রকাশ করা হয়ে থাকে। কেন? কোনটা সুন্দর কোনটা অসুন্দর সেটা কেন একটা বিজ্ঞাপন এর মাধ্যমে বিচার করবো?
আমাদের অধিকাংশের ধারণা এটাই যে, ফর্সা মানেই সুন্দর, ফর্সা মানেই সফল। এই প্রবণতা আমাদের মাঝে ঢোকানোর জন্য মিডিয়াই বেশিরভাগ দায়ী। চাকরি আপনার গায়ের রং এর জন্য নয়, আপনার যোগ্যতায় পাবেন। সময়টা এমনই চলে এসেছে। যদিও এখনো কারো কারো মাঝে এমন দেখা যায়। কিন্তু আমরা নিজেদের চেষ্টায় সেটাও ঠিক করে ফেলতে পারবো আশা করছি।
কালোকে উপস্থাপন: চলুন, আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে একটু জিজ্ঞাসা করে দেখি যে, আমরা কতবার দেখেছি সিনেমার নায়িকাদের গায়ের রং কালো? রূপকথার গল্পে রাজকন্যা কালো কখনো পড়েছি কি? সবসময় দেখে আসছি সিনেমার ভিলেন বা গল্পের ডাইনী বুড়িটা কালো কুৎসিত।
দৃষ্টিভঙ্গি: আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টিই সুন্দর। তবে এই চিত্র কেবল আমাদের উপমহাদেশেই। যদি সারা-পৃথিবীতেই তাই হতো তাহলে বারাক ওবামা কালো বউকে ভালোবেসে ঘর করতেন না। অথচ এই কালো রঙের জন্য গ্রাম/মফস্বলে পর্যন্ত যৌতুকের বলি হতে হয় প্রতিনিয়ত। বিয়ের পর নির্যাতনেরও স্বীকার হতে হয়। একমাত্র আমাদের চিন্তা ভাবনা যদি পরিবর্তন করতে পারি তাহলে এই বৈষম্য দূর করা সম্ভব । দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর চেষ্টা করি। আমাদের দেশে মানুষের চিন্তা–চেতনা, মস্তিষ্ক–মন যত দিন না বর্ণবাদ থেকে বেরোতে পারবে ততদিন আমরা পিছিয়েই থাকবো।
বিভেদরেখা টানা: গায়ের রং এর বিভেদরেখার মাধ্যমেই কিন্তু পরিবার ও সমাজে বর্ণবাদের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়! একজন মানুষের গায়ের রঙ কখনোই তাঁর সৌন্দর্যের মাপকাঠি হতে পারে না! এই কালোর মাঝেও কিন্তু সৌন্দর্য আছে। কখনো কখনো সুন্দর সুন্দর ফটোগ্রাফি দেখা যায় কালো মেয়েদেরকে নিয়ে। তখন কিন্তু এই কালো মেয়েটিকে তারা সুন্দর ভাষায় কৃষ্ণকলি বলে, কিন্তু এই একই মেয়েকে বাস্তব জীবনে কালো মেয়ে ছাড়া কখনই কারো কাছে কৃষ্ণকলি শুনতে দেখা যায়না।
যোগ্যতা: আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সৌন্দর্য। সেটা কি শুধুমাত্র ফর্সা রঙ এর মাঝেই সীমাবদ্ধ? পৃথিবীর ইতিহাসে সাফল্যের শীর্ষে আছে অনেক কালো বর্ণের মানুষ । যারা তাদের যোগ্যতায় এই সাফল্য অর্জন করেছেন। যাদের চাহিদা অনেক বেশি। যেমনঃ আমাদের দেশের টপ মডেল সাদিয়া ইসলাম মৌ বা আজরা, গায়িকা বেবি নাজনীন বা কৃষ্ণকলি।
বিখ্যাত মানুষের উদাহরণ: সারাবিশ্বে এমন বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্ব আছেন যারা কালো বর্ণের। বিখ্যাত হতে গায়ের রং জরুরি নয়। এর জন্য প্রয়োজন মেধা, চেষ্টা ও দক্ষতা। এসব গুণের সমন্বয় ঘটাতে পারলে জায়গা করে নেওয়া যায় মানুষের মনে। নিজের নামটি প্রতিষ্ঠিত হয় বড় জায়গায়। এমন অনেক কৃষ্ণাঙ্গ রয়েছেন, যারা করেছেন বিশ্বজয়।
প্রথমেই যার নাম বলা যায়- নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রথম রাষ্ট্রপতি। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। অনেক সংঘাতের পর তিনি তার দলের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অংশ নেন। ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে।
কন্ডোলিৎসা রাইস- যিনি কন্ডোলিজা রাইস নামেও পরিচিত, পেশাগত জীবনে একজন অধ্যাপক, কূটনীতিক, লেখিকা, ও জাতীয় নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ। তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান নারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনিও কিন্তু একজন কালো বর্ণের মানুষ।
কফি আনান- তিনি ছিলেন একজন কূটনীতিবিদ এবং জাতিসংঘের সপ্তম মহাসচিব। এছাড়া নেলসন ম্যান্ডেলা প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংগঠন দা এল্ডারস-এর চেয়ারম্যান হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
মার্টিন লুথার কিং- মার্টিন লুথার কিং সম্পর্কে নতুন করে আর বলার নেই। সাদার দুনিয়ায় যে কজন কালোর দাপট আজও অগ্রগণ্য তাদের মধ্যে মার্টিনের অবস্থান সবার উপরে।
মোহাম্মদ আলী- মোহাম্মদ আলীর নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একজোড়া গ্লাভস হাতে দানবীয় শক্তির সেই মানুষটির অবয়ব। দুই হাতের কব্জি দিয়ে যিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গোটা বিশ্ব।
পেলে– শুধু ব্রাজিল বললে ভুল হবে, বিশ্ব ফুটবলের একজন অন্যতম জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি।
কালো মানে কি আসলেই অসুন্দর? আল্লাহ তাদের গায়ের রংটা হয়তো কালো করে পাঠিয়েছেন কিন্তু অন্যান্য গুণাবলিতে তারা অনন্য। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান দেখবেন জীবন টাই বদলে যাবে। আল্লাহ বলেছেন,
‘আর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য। (সুরা রুম, আয়াত ২২)
অবশ্য আগের তুলনায় এই চিন্তাধারাটি অনেক ক্ষেত্রেই পরিবর্তন হয়েছে। যারা এখনো কালো কে অসুন্দরের প্রতিশব্দ মনে করেন, তাদের বলছিঃ নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। দেখবেন এই সামান্য পরিবর্তনে আপনার জীবনটা আরো সুন্দর হয়ে উঠবে।
মাশাল্লাহ জাজাকাল্লাহ খাইরান