রক্তের সম্পর্কের মধ্যে বিয়ে বাংলাদেশে খুব প্রচলিত না হলেও, খুব একটা বিরল ব্যাপার নয়। কিছু কিছু এলাকায় তো এটা রীতিমতো একটা সংস্কৃতি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা মোট বিবাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। এমনকি এই প্রবণতা দক্ষিণ ভারতেও দেখা যায়। যদিও হিন্দু সংস্কৃতিতে রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়র সঙ্গে বিয়েতে বিধিনিষেধ রয়েছে। এই ‘কাজিন ম্যারেজ’ ভালো নাকি মন্দ তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে।
ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে
মানবজাতির সর্ব প্রথম বন্ধন স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন। আল্লাহ তায়ালা যখন আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) কে সৃষ্টি করেছিলেন, তখন হাওয়া (আঃ) কেও সৃষ্টি করেন এবং জান্নাতে বসবাস করার সুযোগ দেন। কিন্তু শয়তান এর প্ররোচনায় নিষিদ্ধ গাছের ফল খাওয়ার জন্য তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। এরপর তারা পৃথিবীতে একসাথে বসবাস শুরু করেন এবং সন্তান-সন্তদি লাভ করেন। আদম এবং হাওয়া (আঃ) মোট আশি জোড়া (একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে) সন্তান লাভ করেন। সেই সময়ে আল্লাহর নির্দেশে আগের জোড়ার ছেলের সাথে পরের জোড়ার মেয়ের, পরের জোড়ার ছেলের সাথে আগের জোড়ার মেয়ের বিয়ে হত। তখন নিজের ভাই বোনের মাঝে বিয়ে হত শুধুমাত্র প্রয়োজনের খাতিরে।
সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে ইসলামে বেশ কিছু রক্তের সম্পর্কের মানুষের সাথে বিয়ের সম্পর্ক নিষিদ্ধ করা হয়েছেে। একটি ছেলের জন্য যে সকল মানুষের সাথে ইসলামে বিয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে তারা হলঃ মা, ঔরসজাত কন্যা, বোন, ফুফু, খালা, ভাইঝি, দাদী, নানী, ছেলের মেয়ে, মেয়ের মেয়ে, বোনঝি, দুধ-মা(দুগ্ধপোষ্য অবস্থায় যদি অপর কোনো মহিলার দুধ পান করে), দুধ বোন, সৎ কন্যা, ঔরসজাত পুত্রের স্ত্রী এবং একই সাথে দুই বোনকে। (সূরা আন-নিসাঃ ২৩-২৪)।
এই কয়েকটি সম্পর্কের মানুষ ছাড়া ইসলাম অন্যান্য যে কোন সম্পর্কের কাউকেই বিয়ে করতে নিষেধ করেনি। আমাদের নবী কারীম (সাঃ) তার প্রিয় কন্যা ফাতিমা (রাঃ) এর বিয়ে দিয়েছিলেন হযরত আলী (রাঃ) এর সাথে, যিনি ছিলেন নবী (সাঃ) এর চাচার ছেলে। এছাড়াও মহানবী (সাঃ) বিয়ে করেছিলেন, জয়নাব বিনতে জাস কে, যিনি ছিলেন মহানবী (সাঃ) এর চাচার মেয়ে। সুতরাং, উল্লিখিত সম্পর্ক ছাড়া অন্যান্য আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ নয়।
তবে ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) বলেছেন: “যে সম্প্রদায়ের মহিলারা বাইরের কোন পুরুষকে বিবাহ করে না এবং পুরুষেরা বাইরের কোন মেয়েকে বিবাহ করে না, তাদের সন্তান হয় বোকা ধরনের। (আল ইনতিকা ফি ফাদায়িলিস ছালাছাতিল আয়িম্মাঃ ১/৯৮)। এছাড়া ইমাম গাযযালী (রহঃ) পাত্রী পছন্দ করার ব্যাপারে যেসব দিক নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল- পাত্রী যেন নিকটবর্তী আত্মীয় না হয়। কেননা, তা তাদের জৈবিক কামনাকে কমিয়ে দেবে। (ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন:২/৪১)। নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন যেমন-ফুফাতো, চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাই বোনদেরকে বিবাহ করলে সন্তান দুর্বল হয় বলে অনেক ইসলামিক স্কলারের অভিমত। সে জন্য বলা হয়, বিবাহ দূরবর্তীদের সাথে হলেই ভালো হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ে
চিকিৎসাবিজ্ঞান অবশ্য রক্ত সম্পর্কের বিবাহকে বেশি উৎসাহ দিতে রাজি নয়। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড শহরে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিয়ের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের জীনগত অস্বাভাবিকতার হার এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকি সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এসব অস্বাভাবিকতার মধ্যে নবজাতকের অতিরিক্ত আঙুল গজানোর মতো সমস্যা থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র বা মস্তিষ্কের গঠন প্রক্রিয়ায়, চোখে ও অন্যান্য স্বাস্থ্য ত্রুটি দেখা দিতে পারে। অবশ্য সার্বিক বিবেচনায় এ ধরণের অস্বাভাবিকতার হার খুবই কম।
বলা হয় ফার্স্ট কাজিনদের (সরাসরি খালাতো, মামাতো, চাচাতো বা ফুফাতো ভাইবোন) জীনগত মিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ, অর্থাৎ তারা বংশপরম্পরায় অনেক জীন একইভাবে বহন করে চলেছেন। এ কারণে যে সব রোগবালাই তাদের বংশে রয়েছে, সে সব তাদের সন্তানদের মধ্যে আরও প্রকটভাবে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে অটোসোমাল রিসেসিভ কিছু রোগ (যেমন, থ্যালাসেমিয়া, সিকল সেল অ্যানিমিয়া, সিস্টিক ফাইব্রোসিস) পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে তীব্রতর হয়ে দেখা দিতে পারে। নিজ বংশ এবং নিজ গোত্রে বিবাহরীতির কারণে থ্যালাসেমিয়া ও জিনগত রক্তরোগ মধ্যপ্রাচ্যে একসময় এত প্রকট আকার ধারণ করেছিল যে, আরব সরকার বিয়ের আগে বর-কনের কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে দেয়। এ ছাড়া গবেষণা বলছে, পরস্পরের আত্মীয় স্বামী-স্ত্রীর সন্তানদের মধ্যে জন্মগত জটিলতা, ডাউনস সিনড্রোম, গর্ভপাত বা নবজাতক মৃত্যুর হার অন্যদের তুলনায় সামান্য হলেও বেশি।