মাসনা (الْمَثْنَى) একটি আরবি শব্দ যা ইসলামে দ্বিতীয় বিয়েকে নির্দেশ করে। ইসলামী শরীয়তে, পুরুষদের নির্দিষ্ট শর্তাবলীর অধীনে একাধিক বিবাহ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে মাসনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাসনার মূল উদ্দেশ্য হল সমাজে নারীদের সুরক্ষা ও তাদের অধিকার নিশ্চিত করা। তবে এটি অবশ্যই ন্যায়বিচার ও সমতা রক্ষার শর্তাবলীর সাথে মেনে চলতে হবে।
একাধিক বিয়ে যারা করেন বা করতে চান তাদেরকে সমাজের মানুষ ভাল চোখে দেখেনা। কারণ যে সব পরিবারে একাধিক স্ত্রী আছে তাদের বিভিন্ন সমস্যা হয়। আর এই সমস্যাগুলো নিয়ে সমাজে অনেক সমালোচনা হয়। আবেগের বশে অনেকেই স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ২য় বিয়ে করতে চায়। আবেগ যখন শেষ হয়ে যায় তখন সমস্যা শুরু হয়। সংসারে খরচ অনেক বেশি হওয়া শুরু হয়ে যায়। উভয়কে খুশি করা অনেক কষ্টকর ব্যাপার। এজন্য ইসলামে একাধিক বিয়েকে অনুমোদন দিলেও শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে সুবিচার করার।
“সেসব মেয়েদের মধ্যে থেকে যাদের ভাল লাগে তাদের বিয়ে করে নাও দুই, তিন, কিংবা চারটি পর্যন্ত। আর যদি এরূপ আশঙ্কা কর যে, তাদের মধ্যে ন্যায় সঙ্গত আচরণ বজায় রাখতে পারবে না, তবে একটিই, অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসীদেরকে; এতেই পক্ষপাতিত্বে জড়িত না হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা।” [সূরা নিসা : আয়াত ৩]
মাছনার পক্ষে কিছু কথাঃ
মাছনার পক্ষে ইসলামিক বক্তব্য হল মাছনা মুসলিম সমাজে একটি স্বাভাবিক বিষয়। অর্থাৎ একজন পুরুষ তাঁর যুক্তিসংগত প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করবে। তবে একটি বড় শর্ত রয়েছে, -সবার প্রতি সুবিচার অর্থাৎ একদিকে বেশি ঝুঁকে পড়া যাবেনা।
যুক্তিসংগত প্রয়োজনে একাধিক বিয়ে করতে পারে একজন পুরুষ যেমন,
(১) বর্তমান স্ত্রী শারীরিক বা মানসিকভাবে অসুস্থঃ একজন পুরুষ বিভিন্ন কারণে ঘরের বাইরে থাকতে হয়। ব্যবসা, চাকুরি বা অন্য যেকোনো কাজের জন্য। এক্ষেত্রে ঘর সামলানো স্ত্রীর দায়িত্ব বা কর্তব্য। সন্তানদেরকে দেখাশুনা করা, ঘর গোছানো ইত্যাদি কাজ অসুস্থ মানুষের দ্বারা সম্ভব হয়না। আর এই অসুস্থতা যদি দীর্ঘদিন হয় বা এমন রোগ যা সহজে সুস্থ হওয়ার মতন নয়। সেক্ষেত্রে পরামর্শ সাপেক্ষে আরেকটি বিয়ে করা যেতে পারে। তবে সবার প্রতি সুবিচার করতে হবে-এমন মনমানসিকতা থাকতে হবে।
(২) স্ত্রী নিকটে থাকেনাঃ অনেক সময় পেশা, চাকুরি বা পারিবারিক কারণে স্ত্রী কাছে থাকেনা। সেক্ষেত্রে নিজের সহযোগিতার জন্য কেউ চাইলে বর্তমান স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে আরেকটি বিয়ে করতে পারে। এক্ষেত্রেও নিজের ভিতর সবার প্রতি ইনসাফ করার মনোভাব থাকতে হবে। যেমন, বর্তমান স্ত্রীর ভরণপোষণ, তাঁর জৈবিক চাহিদা ইত্যাদি সমানভাবে করতে হবে। সবাইকে নিয়ে লটারি করে ভ্রমনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। স্ত্রী চাইলেও সব সময় স্বামীর সংগ দিতে পারেনা। অনেক ধনী লোক ব্যবসায়িক কাজে দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থাকেন। এসময় যদি তাঁর একজন স্ত্রী পাশে থাকে তাহলে তাঁর মন-মানসিকতা ভাল থাকবে। এসব লোক আর পর-নারীর প্রতি আকৃষ্ট হবেনা।
(৩) সন্তান না হওয়াঃ বর্তমান স্ত্রীর দীর্ঘদিন সন্তান না হলে বা অনেক চেষ্টা করেও মেডিক্যালি সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা না থাকলে পরামর্শ করে আরেকটি বিয়ে করতে পারে। পারিবারিকভাবে সবাইকে জানিয়ে বিশেষ করে বর্তমান স্ত্রীকে বুঝিয়ে বিয়ে করতে হবে। পুরুষেরও মেডিক্যালি সন্তান হওয়ার মতন অবস্থা আছে কিনা দেখতে হবে। তাঁর সমস্যা থাকলে চিকিৎসা করাতে হবে।
(৪) বর্তমান স্ত্রী জৈবিক চাহিদা পুরণে সক্ষম না হলেঃ পুরুষের যদি জৈবিক চাহিদা অত্যধিক থাকে যা বর্তমান স্ত্রীর দ্বারা মেটানো সম্ভব না হয় তাহলে বিপথগামী বা ব্যভিচারের দিকে যাওয়ার চাইতে আরেকটি বিয়ে হতে পারে সুন্দর সমাধান। তবে এসব বিষয় সমান অধিকারের বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
(৫) নিজের সম্পদ রক্ষার্থেঃ অনেক সম্পদের মালিক অথচ সন্তান মাত্র একজন বা দুইজন। এতে নিজের সম্পদের দেখাশুনা বা ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কেউ চাইলে একাধিক বিয়ে করতে পারে। যাতে তাঁর সম্পদ দেখাশুনার জন্য যথেষ্ট উত্তরাধিকার থাকে। অন্যদিকে আরেকজন মেয়ের স্বামী পাওয়াতে বিরাট উপকার হবে। সমাজ থেকে পরকীয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
(৬) পুরুষের অধিকার একাধিক বিয়েঃ উপরে উল্লিখিত কারণ ছাড়াও একজন পুরুষ একাধিক বিয়ে করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাঁর শুধু সুবিচারের মনমানসিকতা থাকতে হবে। একজন স্ত্রীর বিয়ের পরে কিছু প্রয়োজন থাকে সেসব প্রয়োজন পুরণ করার সামর্থ্য থাকতেই হবে।
মাছনা সংক্রান্ত কিছু সমস্যা নিম্নরূপঃ আপনি যদি নিজের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন তাহলে একাধিক বিয়ে করতে পারেন। সমাজে অধিকাংশ মানুষ যারা একাধিক বিয়ে করে তারা এই সুবিচার করতে পারেনা ফলে সমস্যা হয়।
১) দায়িত্ব বুঝতে না পারাঃ একজন পুরুষের বিয়ের পরে তাঁর স্ত্রীর প্রতি যে কি পরিমাণ দায়িত্ব রয়েছে তা সঠিকভাবে বুঝতে না পারার কারণে সমস্যা হয়। আবেগের বশবর্তী হয়ে অনেকে একাধিক বিয়ে করতে চায়। বিয়ের পর থেকে স্ত্রীর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত ঐ স্বামীকে স্ত্রীর ভরণ পোষণ অর্থাৎ স্ত্রীর মৌলিক চাহিদাকে পূরণ করতে হবে। যেমন স্ত্রীর খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক ইত্যাদি।
(২) সন্তানেরা যথেষ্ট পারিবারিক সাপোর্ট পায়নাঃ যেসব পরিবারে একাধিক স্ত্রী আছে তাদের সন্তানেরা যথেষ্ট পারিবারিক সাপোর্ট থেকে বঞ্চিত হয়। একই পিতার আয়-রোজগারের দ্বারা যখন অনেক লোকের দায়িত্ব পালন করা হয় তখন কিছুটা হলেও সন্তানেরা সাপোর্ট কম পায়। তাছাড়া সতীনদের মধ্যে বনিবনা না হওয়া আমাদের উপমহাদেশে খুব স্বাভাবিক বিষয়।
তবে আরব দেশে মাছনা খুব সাধারণ বিষয়। কারণ তাদের ইমান, আকিদা ও পারিবারিক শিক্ষা আমাদের চাইতে অনেক উন্নত মানের এবং উদার।
এছাড়া বিভিন্ন সমস্যা মাছনার কারণে হতে পারে। তাই একজন পুরুষকে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে এসব বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। তবে যদি স্ত্রীদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা যায়, সমানহারে খোরপোষ দেওয়া যায়, সবাইকে সমান সময় দেওয়া হয় তাহলে এই সমস্যা হবেনা।
অপরদিকে মাছনার দ্বারা বহু সমস্যার সমাধান হবে। অনেক মেয়ে স্বামী পাবে, নিরাপত্তা পাবে। যাদের আর্থিক সমস্যা নেই তাদের উচিত একাধিক বিয়ে করা। এতে মেয়েদের চাহিদা এবং সম্মান বাড়বে। মাছনার দ্বারা পরকীয়া কমে যাবে, ডিভোর্স কমে যাবে, অসহায় বা বিধবা মেয়েদের শান্তির ফয়সালা হবে।
মাছনার পক্ষে-বিপক্ষে কিছু ব্যক্তিগত বক্তব্য তুলে ধরলাম। জীবন আপনার, সিদ্ধান্ত আপনার। সুন্দর জীবনের জন্য যাকিছু প্রয়োজন করবেন।