বিবাহিত জীবনে বিভিন্ন কারণে অশান্তি আসতে পারে। তবে আমাদের প্রতিদিনের সামাজিক জীবনের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষিতে পূর্বের ধারাবাহিক আলোচনার সাথে আরও কিছু কারণ আলোচনা করা হল-
আর্থিক অসংগতিঃ
আর্থিক সমস্যা বিবাহিত জীবনের অশান্তির একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। স্বামী-স্ত্রী উভয়ের চাহিদা, সামাজিক মর্যাদা রক্ষা ইত্যাদি কারণেও দাম্পত্য জীবনে অশান্তি আসতে পারে। যদিও উপার্জনের মূল দায়িত্ব স্বামীর তবে এক্ষেত্রে স্ত্রীকে খরচের ব্যাপারে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করতে হবে। নিজের চাহিদাকে সীমিত রাখতে হবে। পরিবারের খরচের ব্যাপারে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ। মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে এ প্রসঙ্গে বলেন,
এবং তারা যখন ব্যয় করে, তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী। (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত নং-৬৭)
বাস্তবতাকে মেনে না নেওয়াঃ
বিয়ের পরে একে অপরের অনেক অসঙ্গতি ধরা পড়ে। যেমন, স্বামী একটি জিনিস খুব পছন্দ করে অথচ স্ত্রী তা অপছন্দ করে। ফলে একটি জিনিস নিয়ে দ্বিমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়। যার ফলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে ছাড়ের মন মানসিকতা থাকতে হবে। বিবাহিত জীবনে এই বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার মন মানসিকতা সৃষ্টি করতে হবে।
ধর্মীয় শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের অভাবঃ
ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে বিনয়ী, আত্মত্যাগী হতে শিক্ষা দান করে। দুনিয়ার জীবন যেকোনভাবে একসময় শেষ হয়ে যাবে। আর আল্লাহ্ তাআলা আখিরাতে সকল আশাকে পূর্ণ করে দিবেন। মহান আল্লাহ্র সন্তুষ্টির আশায় এবং আখিরাতে পূর্ণ জীবন পাবার জন্য একজন ধার্মিক মানুষ দুনিয়াতে অনেক কিছুই মেনে নেয়। কিন্তু যে পরিবারে এই ধর্মীয় শিক্ষা নেই, সেই পরিবার সাধারণত এসব কষ্টকে মেনে নিতে চায় না। ফলে দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হয়।
গীবত বা পরচর্চা সহ সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপকতাঃ
গীবতের মাধ্যমে সমাজে সবচাইতে বেশি অশান্তির সৃষ্টি হয়। গীবত হল কারও অসাক্ষাতে এমন কিছু বলা যা শুনতে সে অপছন্দ করে।আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেনঃ একদা এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করেঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! গীবত কি?
তিনি বলেনঃ তোমার ভাই সম্পর্কে (তার অনুপস্থিতে) এমন কিছু বলা, যা শুনলে সে ব্যথিত হয়। তখন সে বলে, আমি যে কথা বলি, তা যদি তার মধ্যে থাকে? (তবে কি গীবত হবে?) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ তুমি যা বলছো, তা যদি তার মধ্যে থাকে, তবে তুমি তার গীবত করলে ; আর সে দোষ যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তো তুমি তার উপর মিথ্যা দোষারোপ করলে, (যা গীবত থেকে অধিক দোষণীয়)।
এই গীবতের কারণে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয় যা এক সময় স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিরাট সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই গীবর বা পরচর্চা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।
সন্তান সময়মত না নেওয়াঃ
সময়মত সন্তান না নেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে অনেক সময় অশান্তি শুরু হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরে ভালবাসা সৃষ্টিতে সন্তান গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখে। স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে সম্পর্ক নবায়ন করা এবং মজবুত করার একটি মাধ্যম হচ্ছে সন্তান। কিন্তু সন্তান যখন সময়মত নেওয়ার চেস্টা করা হয়না তখন একে অপরের প্রতি লেগে থাকা অভিমান গুলো আরও বড় হয়। এতে অশান্তি বাড়তে থাকে। সন্তান না নেওয়াকে কেন্দ্র করেও অনেক সময় একে অপরকে দোষারোপ করা হয়।
সম্পদের প্রতিযোগিতাঃ
সম্পদের লোভ থেকে বা প্রতিযোগিতা থেকেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি সৃষ্টি হতে পারে। স্বামী তাঁর স্ত্রীর বাড়ি থেকে বিভিন্ন বাহানায় টাকা-পয়সা চাইতে থাকে। আর এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। আবার সম্পদের প্রতি স্ত্রীর লোভের কারণে স্বামী বিভিন্নভাবে অর্থ উপার্জন শুরু করে- এর ফলে অনেক সময় দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
সন্তানদেরকে বেশি সময় দেওয়া বা স্বামী-স্ত্রীর জন্য আলাদা সময় বরাদ্দ না করাঃ
স্বামী-স্ত্রীর সু সম্পর্ক মজবুত করার ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপুর্ণ উপায় হল নিজেদের মধ্যে একান্তে বেশি সময় কাটানোর চেস্টা করা। কিন্তু সন্তান হওয়ার পর তাদের জন্য এত বেশি সময় বরাদ্দ করা হয় যে নিজেদের কথা একেবারেই ভুলে যায়। এর ফলেও দূরত্ব সৃষ্টি হতে পারে।
একে অপরের সাথে তুলনা করাঃ
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অশান্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে তুলনাও একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। স্ত্রীদের মধ্যে একটি সমস্যা বেশি দেখা যায় যে কারও বাড়িতে কিছু দেখে আসলে সেই জিনিস নিজের বাড়িতেও চাই- এই জিদ এক সময় বিরাট অশান্তির সৃষ্টি করে। একইভাবে স্বামী যখন নিজ স্ত্রীকে অন্য কারও স্ত্রীর সাথে তুলনা করে তখনও দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হয়।
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মনোমালিন্য বাইরের মানুষকে জানানঃ
স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মান-অভিমান নতুন কিছু নয়। এই মান-অভিমান খুব দ্রুত মিটে যায়, কিন্তু মাঝে যদি অন্য কেউ প্রভাব খাটাতে চায় তখন আর সহজে সমস্যা মিটেনা। এভাবে অশান্তি বাড়তে থাকে।
ডিভোর্স সম্পর্কে সমাজের নেতিবাচক প্রভাবঃ
ডিভোর্সী ছেলে বা মেয়েকে সমাজে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। অথচ দাম্পত্য জীবনে বছরের বছর চলমান কলহ বিবাদ থেকে উত্তরণের জন্যই ডিভোর্স। যেখানে সম্পর্ক কোনভাবেই আর চালানো সম্ভব হচ্ছেনা, একে অপরের প্রতি ক্ষুদ্ধ ও ভয়াবহ অবস্থা এমনকি আত্মহত্যারও মত বিষয় আসতে পারে সেক্ষেত্রে ডিভোর্স সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছে। হয়ত এমন হতে পারে ডিভোর্সের পর আবার নতুন সম্পর্কে সৃষ্টি হয়ে সেখানে সহজে মিলমিশে আনন্দে চলতে পারে।
অভিভাবক বা পিতা-মাতার অনুমতি ব্যতীত বিয়েঃ
বর্তমানে বিভিন্ন সময়ে অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই অনেক বিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। পাত্র-পাত্রীর নিজস্ব ইচ্ছায় এই সব বিয়ের পরে কেউ কেউ শান্তিতে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই কিছুদিন ভাল থাকলেও কিছুদিন পর থেকে শুরু হয় অশান্তি। কারণ এই আবেগের রেশ যখন কেটে যায়, বাস্তবতা সামনে আসে তখন ভালবাসা আর বেশি সময় থাকেনা। সাধারণতঃ অপ্রাপ্ত বয়সের ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে এমন ঘটে থাকে।
বিয়ের পরে আর্থিক সমস্যা থেকে শুরু করে, নিজেদের আবেগী মনের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। অপরদিকে বাবা-মায়ের অমত থাকায় তাদের থেকে যে সহযোগিতার পাওয়ার কথা তা আর পায়না। মেয়ে তাঁর স্বামীর বাড়ির শাশুড়ি- শ্বশুর সহ অন্যান্য আত্মীয় স্বজনের অবহেলার শিকার হয়। আর ছেলে এসব কিছু ম্যানেজ করতে করতে একসময় স্ত্রীর প্রতি অবহেলা শুরু করে দেয়। অপরদিকে মেয়েটি যেহেতু তাঁর বাবা-মায়ের অসম্মতিতে বিয়ে করেছে তাই নিজের বাবা মায়ের কাছেও কিছু বলতে পারেনা।
এছাড়া বাবা মায়ের অনুমতি ব্যতীত বিয়ে হলে তারা বাবা মায়ের দোয়া পায়না। এমনকি পরিবারের অন্যান্য আত্মীয়স্বজনদেরও দোয়া পায়না। ফলে তারা আল্লাহ্র অনেক বড় রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। যা তাদের মানসিক অশান্তিকে বাড়িয়ে দেয়।
অভিভাবকের অনুমতি ব্যতিত বিয়েকে ইসলাম সমর্থন করেনা।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করবে তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল, তার বিবাহ বাতিল।’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ১০২১)
বিবাহিত জীবনে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকলে আশা করা যায় আমরা শান্তি, সফলতা পাব।